বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে ফিরোজ। নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া জাহির এলাকায় ‘ডাকাত ফিরোজ’ নামে পরিচিত। মুরাদপুর-বহদ্দারহাট এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্মের হোতা সে।
এক সময় সে ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবেও পরিচিত ছিল। নিজের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে যুক্ত হয় ক্ষমতাসীন দলে। সময় বুঝে দল পাল্টানো ফিরোজকে গত বৃহস্পতিবার ফেনী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সে চান্দগাঁও থানার মুরাদপুর এলাকার আব্দুল হামিদের ছেলে। ছাত্র আন্দোলনে গুলি ছাড়াও ফিরোজের বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, নাশকতা, মাদক, ছিনতাইসহ পাঁচটি মামলার রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডাকাত ফিরোজ নামে পরিচিত এই ফিরোজ একসময় পরিচিত ছিল ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে যুবলীগ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে পোস্টার-ব্যানার টানায়। যুবলীগের মিছিল-সমাবেশেও দেখা যেত সামনের সারিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফিরোজের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।
২০১৫ সাল থেকে ফিরোজ নিজেকে যুবলীগের নেতা দাবি করে আসছে। ওই বছরের ডিসেম্বরে নগরে বিলবোর্ড টানিয়ে আলোচনায় আসে ফিরোজ। তখন যুবলীগের মিছিল-সমাবেশে সামনের সারিতে দেখা যেত তাকে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং ২০১৩ সালের জুলাই মাসে দুবার পুলিশ তাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। সর্বশেষ চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামিও ফিরোজ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরের প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে সন্ত্রাসীরা ১১ লাখ টাকা লুট করে নেয়। মারধর করা হয় একজন চিকিৎসককে। এ ঘটনার পরদিন নগরের বায়েজিদ থানার কয়লাঘর এলাকা থেকে ফিরোজ ও মনিরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে ফিরোজের পাঁচলাইশের আস্তানা থেকে ১২টি গুলিভর্তি দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন, একটি একনলা বন্দুক, একটি বন্দুকের ব্যারেল, তিনটি কার্তুজ ও দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালেই ফিরোজ তখন দাবি করেছিল, অস্ত্রগুলো দুর্ধর্ষ ‘শিবিরি ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ম্যাক্সন ও সরওয়ারের।
২০১৩ সালের ১৯ জুলাই রাতে তিনটি গুলিভর্তি একটি নাইন এমএম পিস্তলসহ আবারও ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামিও সে।
গত ১৬ জুলাই নগরের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের হামলা করতে দেখা যায়। তাদের হাতে ছিল লাঠিসোটা, পাথর, রামদা, ককটেল ও অস্ত্র। ওই সময় যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত ফিরোজের শটগান হাতে গুলি লোড করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। ওইদিন ১৬ বছর বয়সী দোকান কর্মচারী সায়মান ওরফে মাহিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় তার বন্ধু মোহাম্মদ শরীফ বাদী হয়ে চান্দগাঁও থানায় ৪৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
ওইদিন সংঘর্ষে দোকান কর্মচারী মাহিন ছাড়াও আরও তিনজন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের সদস্য। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা এলাকার শফিউল আলমের ছেলে। অন্যজন ফারুক, তিনি পথচারী ছিলেন। ফারুকের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি ফার্নিচারের দোকানে চাকরি করতেন। আরেকজন চট্টগ্রাম নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আহমেদ শান্ত।
একাধিক সূত্র জানায়, ১৬ জুলাই দুপুর ২টা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের নেতৃত্বে ষোলশহর স্টেশনে অবস্থান নেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। অন্যদিকে মুরাদপুরে অবস্থান নেন কোটা আন্দোলনকারীরা। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যুবলীগ নেতা নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে একটি মিছিল যায় মুরাদপুরের দিকে। এ সময় কোটা আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দিলে পিছু হটেন তারা। এরপর মিছিল থেকে গুলি করতে দেখা যায় ফিরোজকে। একপর্যায়ে গুলি থামিয়ে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘গুলি দে, গুলি দে’। কিছুক্ষণ পর একজন গুলি এনে দেয় তাকে। গুলি লোড করে আবারও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সে।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফেনীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্র আন্দোলনে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়া ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ বিষয়ে র্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. শরীফ-উল-আলম কালবেলাকে বলেন, ফিরোজের বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, নাশকতা, মাদক, ছিনতাইসহ পাঁচটি মামলার রয়েছে। তার বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জন্য চান্দগাঁও থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।