Monday, December 23, 2024

দেড় যুগে সবচেয়ে ‘চাঙ্গা’ বিএনপি

আরও পড়ুন

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রায় দেড় যুগের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও দেশে ফেরার প্রক্রিয়া চলছে।

নেতাকর্মীরাও মিথ্যা মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কারাগার থেকে বের হয়ে আসছেন। সবমিলিয়ে সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। এমন অবস্থায় আজ ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে বিএনপি। তবে দেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সীমিত করেছে দলটি। কর্মসূচিতে যে অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা ছিল, সেটি তারা এখন বন্যার্তদের সহায়তায় ব্যয় করবেন।

জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির এখন মূল লক্ষ্য—আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া। এ লক্ষ্যে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মন জয় করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দলের তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলটি মনে করছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইতিহাসের অন্যতম কঠিন পরীক্ষার। তাই জনগণের আস্থা নষ্ট হয়—এমন কাজ পরিহার করে নেতাকর্মীদের মানুষের পাশে থেকে তাদের মন জয়ের জন্য বলা হয়েছে।

বিএনপি বিশ্বাস করে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবে। সেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবেন। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি তারা ধরে রাখবেন এবং রাষ্ট্র কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আনবেন, যার ভিত্তি হবে ‘৩১ দফা রূপরেখা’, যেটা তাদের দলীয় অঙ্গীকার।

সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ওই রূপরেখা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয়করণের কারণে গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় দ্রুততম সময়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোয় যে সংস্কার আনবে, সেগুলোকে তারা ধরে রাখবেন এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

আরও পড়ুনঃ  জুতার মালা পরিয়ে ঢাবির হল ছাত্রলীগ নেতাকে পুলিশে সোপর্দ

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা, জেল-জুলুম, গুম-খুন তথা নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। একই সঙ্গে দলটিকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রামও অব্যাহত রাখতে হয়েছে।

বিএনপির হিসাবে, গত ১৫ বছরে দেড় লাখ মিথ্যা-গায়েবি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় ৫০ লাখের অধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। মামলার বাইরেও এই সময়ে দলটির সহস্রাধিক নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম করা হয়। যাদের মধ্যে এখনো অর্ধশতাধিক গুম রয়েছেন।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি বিএনপির। এরপর ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় সংবিধানে তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। পরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো ফল হয়নি।

এই নির্বাচনের আগে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করে দলটি। বরং বিএনপি এবং মিত্রদের আন্দোলন ও বর্জনের মুখে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় একদিকে হামলা-মামলা-নির্যাতন এবং অন্যদিকে সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনেও কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও চরম হতাশা ভর করে।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। কোটাবিরোধী এই আন্দোলন যে একপর্যায়ে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হবে, শুরুতে সেটি কারোর ভাবনায় ছিল না। ছাত্রদের ওই আন্দোলনে বিএনপি সমর্থন জানায় এবং ছাত্রদলসহ দলটির অন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাতে অংশগ্রহণও করে। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, যেটি ছিল বিএনপির নেতাকর্মীদের বহুদিনের চাওয়া।

আরও পড়ুনঃ  বন্যা নয়, আনসারদের পক্ষ নিয়ে ফেসবুকে জয়ের পোস্ট

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ খালেদা জিয়া স্থায়ী মুক্তি লাভ করেন। ড. ইউনূসের সরকারকে সমর্থন জানিয়ে সার্বিক সহযোগিতার কথা জানায় বিএনপি। একই সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দলীয় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। জনগণের দল হিসেবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের দিকে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। তারেক রহমানের নির্দেশে দলের নেতাকর্মীরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশেও দাঁড়ান, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সীমিত কর্মসূচি: ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে এবার দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমে পাঁচ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল চাঙ্গা বিএনপি। কিন্তু বন্যার কারণে পরে সেই কর্মসূচি সীমিত করা হয়।

পরিবর্তিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আজ রোববার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে দলটি। এর আগে ভোরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এ ছাড়া দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে দেশের মানুষ ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতদের জন্য দোয়া করা হবে; বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাতে দ্রুত দেশে ফিরে আসতে পারেন, সেজন্যও দোয়া করা হবে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালে গৃহবধূ থেকে বিএনপির হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। তিনি দলের চেয়ারপারসন। তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খালেদা জিয়া। সর্বশেষ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দলটি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এরপর ওইদিনই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। তিনি লন্ডনে থেকে স্থায়ী কমিটির পরামর্শে দল পরিচালনা করছেন। সেখান থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন তারেক রহমান। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডন যান তিনি।

আরও পড়ুনঃ  ‘মেইন রাস্তায় উঠলে রিকশা লইয়া যাক, কিন্তু ভিতরে আমাগো চালাইতে দিতে হইবো’

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বাণী দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাণীতে তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে এখন নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। আইনের শাসন, মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই দেড় যুগব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদের আত্মদান সার্থক হবে।

তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্র সমুন্নত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বিএনপির উদ্যোম ও উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে দলটি দেশবাসীর কাছে এখন সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রেখে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের নিবেদন করে বিএনপি আগামী দিনগুলোতেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বিএনপি সৃষ্টির ৪৬ বছর পরে এসে আজ দলের সামনে নতুন করে উন্মুক্ত হয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস, যে ক্যানভাসে অঙ্কিত হবে গণতন্ত্রের নতুন সূর্য। যে স্বাধীনতার ঘোষণা একদিন দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং যে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, সেই গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় আজ রচিত হয়েছে ছাত্র-জনতার বিপ্লব; যেমন সেদিন হয়েছিল সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ভেতর দিয়ে বাকশাল দূর করে বাংলাদেশে প্রথমবারের গণতন্ত্রের পুনরুত্থান! স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আগামীতে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্যে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ