Monday, December 23, 2024

ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন

আরও পড়ুন

অপরাধ করে কারও ফাঁসি হলেও স্বজনরা কখনো লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানান না। তবে ব্যতিক্রম ছিল আট বছরের বেশি সময় আগে রাজধানীর কল্যাণপুরে জাহাজবাড়ীতে তথাকথিত ‘জঙ্গিবিরোধী’ অভিযান। সেই অভিযানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল ৯ তরুণ। তারা ডিবিতে আটক ছিলেন। সন্ধ্যা নামার আগেই আলো-আঁধারি পরিবেশে ডিবি থেকে বের করা হয় তাদের। নেওয়া হয় জাহাজবাড়ীতে। পরদিন ভোরে ফজরের আজানের পরপর গুলি করে নির্মমভাবে খুন করা হয়। পরিবারকে দেওয়া হয়নি লাশ। দেওয়া হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে। নিহতদের কেউ ছিলেন গার্মেন্টকর্মী, কেউ শিক্ষার্থী। তবে তাদের মধ্যে সাতজনই ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

সেই লোমহর্ষক ঘটনা অনুসন্ধান করে এক নির্মম চিত্র পাওয়া গেছে। এই তরুণরা কি জঙ্গি ছিলেন না জঙ্গি সাজানো হয়েছে? আরও আগে তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হলো না, খুন করে লাশ কেন পরিবারকে দেওয়া হয়নি, পুলিশের সাজানো বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় আমার দেশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

‘জাহাজবাড়ী’ হিসেবে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে পুলিশের ‘অভিযান’ চালানো হয় ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই। এসব তরুণকে হত্যার পর বরাবরের মতোই পুলিশের দাবি ছিল— ‘দরজা নক করলে … গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে… আত্মরক্ষার্থে …।’

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে তরুণদের হত্যা করা হয়েছে। এসব তরুণ ছিল ডিবির হেফাজতে। সেখান থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আর একে ইসলামি জঙ্গিকার্ড হিসেবে ব্যবহার করেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকার।

আরও পড়ুনঃ  জাতিসংঘ অধিবেশনে ছোট প্রতিনিধি দল নিয়ে যাবেন ড. ইউনূস

ডিবি থেকে তাদের তুলে নিতে দেখেছেন ব্যবসায়ী শেখ মো. সেলিম হোসাইন। তিনিও কুখ্যাত আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। আয়নাঘরের তথ্য তিনিই প্রথম ফাঁস করেন। জাহাজবাড়ীতে নিয়ে হত্যার আগে ডিবির কাছ থেকে হতভাগ্য তরুণদের তুলে নিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।

সেলিমের চাঞ্চল্যকর তথ্য

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পুরান ভবনে ঢুকতেই ডান দিকের ছোট্ট এক গারদঘরে দীর্ঘদিন বন্দি সেলিম। ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘর থেকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল তাকে। দিনভর সেই গারদের দরজায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন মানুষের আসা-যাওয়া স্পষ্ট দেখতে পেতেন তিনি। পাশেই পুলিশের জন্য স্থাপন করা টেলিভিশনের শব্দও কানে ভেসে আসত।

এক বিকালের ঘটনা। গারদের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। সেদিন একই রুমে তার সঙ্গে ছিলেন সাদ্দাম ও মাওলানা আবুল কাশেম। নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

‘আমাদেরকে ডিবির পুরোনো ভবনের যে সেলে রাখা হইত, এর প্রথমেই একটা সেল ছিল ছোট্ট। এই সেলেই আমি গ্রিল ধইরা দাঁড়াইয়া ছিলাম, দরজার সামনে। এটা থেকে বাইরে পুরা দেখা যায়,’ সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা এভাবেই শুরু করেন তিনি।

এরপর একটা বড়সড় পুলিশ ভ্যান গারদের সামনে পেছন দিক করে দাঁড়ায়। একে একে সেই ভ্যানে আনুমানিক ১০-১১ তরুণকে ওঠাতে দেখেন সেলিম।

আরও পড়ুনঃ  বন্দরে ৩ নম্বর সংকেত, ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা

‘সবার পরনে কালো পাঞ্জাবি। চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে, মুখ খোলা। সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে কালো কয়েকটা পতাকা। তরুণদের ভ্যানে উঠিয়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়ে চলে গেল,’ এভাবেই হিম-করা ঘটনার বর্ণনা শুরু করেন এই প্রত্যক্ষদর্শী।

শেখ সেলিম আমার দেশ-কে বলেন, ‘কালো কাপড় ছাড়াও একই রকমের কাপড়ের পতাকার মতো ওরা পেঁচাইয়া নিয়া যায়। ওদেরকে গাড়িতে নেওয়ার সময় সব পুলিশ ছিল সিভিলে। গাড়িটার পেছনটা আমাদের দরজা বরাবর ছিল। ওদেরকে সেই দরজা দিয়া ওঠায়। সিভিলে ওদের সঙ্গে দু-তিনজন নিয়েছে। ওদের হাত ক্যাবল টাই দিয়া বাঁধা ছিল। প্লাস্টিকের ক্লিপের মতো আর কী! ওরা যখন একজন-একজন করে ওঠে, তখন মেইন দরজা দিয়া আমরা অনেকে দাঁড়াইয়া দেখি। পতাকা পেঁচানো ছিল। আর ওদের মাথার মধ্যে কালো কাপড় ছিল। চোখেও কালো কাপড়ে বাঁধা। পায়ে বেড়ি ছিল না।’

সেই তরুণ কারা

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে অতীতে ডিজিএফআইয়ের ‘আয়নাঘর’ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করা শেখ সেলিম সেদিন ডিবি অফিস থেকে ১০-১১ তরুণকে কালো পাঞ্জাবি পরিয়ে ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী।

আমার দেশ-এর কাছে তিনি সেই তরুণদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। কুখ্যাত আয়নাঘরের তিনি হুইসেলব্লোয়ার।

তার বক্তব্য যাচাই করেছে আমার দেশ। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত রাজধানীর কল্যাণপুরের ‘জাহাজবাড়ী’-তে তথাকথিত জঙ্গি হামলার চাঞ্চল্যকর নাটকের অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসবে বিএনপি

অন্যদিকে হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে প্রচার করা মারজান নামের যে তরুণকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার দাবি করেছিল পুলিশ, প্রকৃতপক্ষে তাকেও ডিবির একটি ছোট রুমে অনেক আগেই ধরে এনে চেয়ারের নিচে মাথা রেখে বেঁধে রাখতে দেখেছেন শেখ সেলিম।

এই প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা রাজধানীর কল্যাণপুরে ‘জাহাজবাড়ী’-তে তথাকথিত জঙ্গিদের সঙ্গে ভয়াবহ গ্রেনেড-বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা একদমই পুলিশের সাজানো নাটক ছিল। সেই তরুণদের আগে থেকেই ডিবি অফিসে বন্দি রাখা এবং পরে তাদের কালো পাঞ্জাবি-ট্রাউজার, মাথায় কালো পট্টি পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর কথা বর্ণনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী শেখ সেলিম।

সেলিম আরও বেশ কয়েকজন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা এই তরুণদের ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন।

বর্তমানে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন শেখ সেলিম।

আর এই ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী, যাকে ‘জাহাজবাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়’ গুলি করে ধরার দাবি করেছিল পুলিশ, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে র‌্যাশ নামের সেই তরুণকেও জুলাই বিপ্লবের সময় গত ৫ আগস্ট কাশিমপুর কারাগারে গুলি করে হত্যা করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

আর সাদ্দাম ও নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে।

চলমানঃ যেভাবে ডিবি থেকে ‘জাহাজবাড়ি’-তে নেওয়া হয় তরুণদের

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ