রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের নেকাব খুলতে বাধ্য করা, বোরকা পরা ও মুখ ঢাকার কারণে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ওই শিক্ষকের করা ‘আপত্তিকর’ কথোপকথনের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
অভিযুক্ত শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান ইসলাম শিক্ষা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সোমবার (১১ মার্চ) সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইসলামিক স্টাডিজ পরিবার (রাবি) নামে একটি গ্রুপে সিদরাতুল মুনতাহা নামে একটি আইডি থেকে পোস্ট করলে মূহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সেটি। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সাথে মেসেঞ্জারে আপত্তিকর কিছু কথপোকথনের স্ক্রিনশট পোস্ট করা হয় ওই গ্রুপটিতে।
পোস্টে সিদরাতুল মুনতাহা লিখেছেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের কাজ কী? অবিবাহিত লুচ্চা শিক্ষকদের কেনো ক্লাস দেয়া হয়, যারা বোরখা এবং হিজাবের মতো এতো সেনসিটিভ একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে? ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক হয়ে তার এই সাহস কিভাবে হলো? নেকাব খুলতে বাধ্য করা, পর্দানশীন মেয়েদের হেনস্তা করা, ‘মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্যাকেট হয়ে এসেছো কেন’ বলতে সাহস পাওয়া, ট্যুরের নাম দিয়ে নিয়ে গিয়ে বাংলা-হিন্দি গানে নিজে নাচা-ছাত্রীদের নাচানো- এসব কিছু এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা কিভাবে করে?
পোস্টে আরও বলা হয়, সংখ্যাটা যদি কমও হয়, অন্য শিক্ষকরা কি এতোটাই জিম্মি তাদের কাছে? নাকি ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে ইসলামী ভাবধারার বাইরের শিক্ষক বেশি? এই শিক্ষককে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলছি, তোমরা এক হও। এসকল বেয়াদব শিক্ষকদের সকল ইয়ারে ক্লাস থেকে বিরত রাখার দাবি জানাচ্ছি। চেয়ারম্যান স্যার এবং ডিন স্যারের কাছে এর একটা সুষ্ঠু ফয়সালা কামনা করছি’।
এবিষয়ে জানতে কথা হয় পোস্টাদাতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১ম বর্ষের ক্লাসে স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। একটা মেয়ে গরম লাগায়, শক্ত একটা কাগজ দিয়ে বাতাস খাচ্ছিল। স্যার তাকে ডেকে বললেন, ‘এতো গরম লাগে, প্যাকেট হয়ে আসো কেনো? কি দরকার এভাবে প্যাকেট হয়ে আসার?”
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, উনি মুখ খুলে প্রেজেন্ট নেন। মুখ না খুললে উনি শুনতে পান না, সবাইকে না তবে ৩/৪ জনকে এমন করেছে। ক্লাসে একটা মেয়েকে যে খাস পর্দা করে, তাকে দাড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘এটা কি ধরনের হিজাবের স্টাইল? এমন প্যাকেট হয়ে আসার কি দরকার? অন্যদের মতো হালকা পরতে পারোনা?’ মেয়েটা বলেছে, ‘স্যার এটা যার যার অভিরুচি’। পরে স্যার তার ওপর রেগে যায়।
এছাড়া, মেসেঞ্জারে করা ওই শিক্ষকের কথোপকথনের স্ক্রিনশটে দেখা যায়, তিনি এক ছাত্রীকে লিখেছেন, ‘একটা কথা বলবো?’ ছাত্রী লিখেছেন, ‘জ্বী স্যার’ তিনি লিখেছেন, ‘অনেস্টলি স্পিকিং, ডু ইউ নোউ ইয়োর আইস ইজ টু মাচ এ্যাট্রাক্টিভ।’ অন্য আরেকটি কথোপকথনে দেখা যায়, শিক্ষক লিখেছেন-‘ক্যান ইউ সেন্ট ইয়োর পিকচার জাস্ট অনলি ফর মি?’ ছাত্রী লিখেছেন- ‘সরি, আই হ্যাভ নো পিকচার’। তখন শিক্ষক লিখেছেন- ‘ হ্যাঁ, জাস্ট লেইম এক্সকিউজ। আই নোউ দ্যাট, ইউ ইউজ স্মার্ট ফোন। সো পিকচার ইজ নাথিং ম্যাটার।’
অভিযোগের বিষয়ের অভিযুক্ত শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি যতদূর জেনেছি, ফেক আইডি থেকে এই ধরনের পোস্ট করা হয়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীদের ফেইক আইডি থেকে পোস্ট করা বিষয়টা কেমন হয়ে যায় না? আর ক্লাসে আমি কখনোই এমন কিছু বলবো না, যেকথায় কারোর হার্টে আঘাত লাগে, কারন আমি একজন মুসলিম। অবশ্যই পর্দাকে সম্মান করতে হবে। সেটা এমনভাবে করবো না বা বলবো না, যেটা কারোর আঘাত লাগে।’
নিজের ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জারে আপত্তিকর মেসেজ পাঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা আমি না দেখে বলতে পারবো না।’
বিষয়টি অস্বীকার করছেন কি না এমন প্রশ্নে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমি ক্লাসে এমন কোনো বক্তব্য দিই নাই, যেটাতে কারোর আঘাত লাগে। আর শিক্ষক শিক্ষার্থীর তো একটু খুনসুটিও হয়। সেটা তো বোঝা যায়, খুনসুটি কি অন্য কিছু। আমরা তখন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলি, তুমি কিছু মনে করলে? বা ভাবছো? এরকম করেও বলি। শিক্ষক শিক্ষার্থীর তো খুনসুটির সম্পর্ক থাকেই। কিন্তু এরকম করে বলবো না যে, কারোর আঘাত লাগবে বা এরকম অভিযোগ আকারে আসবে’।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা প্রসঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষকের নামে এগুলো বলার আগে একটু তো ভাবা দরকার। আমাদের তো বলা যায়। অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না লিখে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান আছে, অনুষদের ডীন আছে, তাদেরকে বলতে পারতো৷ তারপরে যদি মনে করতাম, এটা আমার ভুল হয়েছে বা স্লিপ অব দ্যা টাঙ হয়েছে, তাহলে অবশ্যই সাথে সাথে বলতাম, হ্যা আমার ভুল হয়েছে, সরি। যদি আমার ভুল হয়ে থাকে, তাহলে আমার স্বীকার করতে অসুবিধা নেই। কিন্তু এরকম সিচুয়েশন সৃষ্টি হয়নি।’
বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আশরাফ-উজ-জামান বলেন, ‘আমার কাছে অফিশিয়ালি কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে, আমি শুনছি, এ ধরনের মেসেজ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। তবে আমার মোবাইলে কেউ পাঠায়নি। এমনকি আমার কাছে কোনো ছাত্র-ছাত্রী এখনো আসেনি৷ যথাযথ উপায়ে কোনো অভিযোগ না পাওয়ার ফলে এখনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমিও শুনেছি, এমন অভিযোগ উঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আমি কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করছি, কি করা যায় বিষয়টি নিয়ে।’